প্রকাশিত: ১৯/০৫/২০১৭ ৮:৩৩ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৬:০০ পিএম

আবু তাহের, কক্সবাজার::

গত অক্টোবরে শুরু হওয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচার গণহত্যা, গণধর্ষণ এবং দমন-পীড়নের ঘটনার বড় অংশই অপ্রকাশিত থেকেছে। বিশেষ করে দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশের গণধর্ষণের ভয়াবহতার প্রকৃত চিত্র গণমাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমেও আসেনি। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে কয়েক মাসের দমনমূলক অভিযানের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ৬৪ শতাংশ ঘটনার তথ্য প্রকাশিত হলেও গণধর্ষণের ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ এবং অন্যান্য যৌন নির্যাতনের ঘটনার ৬৯ শতাংশই অপ্রকাশিত থেকেছে। এ নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং দীর্ঘদিনের চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশ বলেই মনে করে কমিশন।

কমিশনের প্রতিবেদনে নৃতাত্তি্বক রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘটিত অপরাধকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নির্যাতনের যতটা বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, সংঘটিত অপরাধের ভয়াবহতা এর চেয়ে অনেক বেশি। ৪৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ২০৪ জন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অপারেশন ক্লিন এরিয়া’ নামক অভিযানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ রোহিঙ্গা নারীদের ব্যাপকহারে গণধর্ষণ করেছে। লুটপাট করেছে তাদের সহায়-সম্বল, পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৯০ হাজার রোহিঙ্গা। এ নির্যাতনের ঘটনায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিশন রাখাইন রাজ্য ঘুরে

চলতি বছরের ১৭ থেকে ২১ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করে। এ সময় তারা ২০৪ জন রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষের সাক্ষাৎকার নেন। তদন্ত প্রতিবেদনে ওই সাক্ষাৎকার ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ যুক্ত রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাক্ষাৎকার গ্রহণ ছাড়াও রাখাইনে সংঘটিত ঘটনার বেশ কিছু ভিডিওচিত্রও সংগ্রহ করেন তদন্ত দলের সদস্যরা। এ ছাড়া স্যাটেলাইট ইমেজ পর্যালোচনা এবং একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তথ্য যাচাই-বাছাই করে এ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে।

২০৪ জনের মর্মস্পর্শী বর্ণনা : তদন্ত দলকে সাক্ষাৎকারদাতাদের মধ্যে ১০১ জন নারী, ২৬ শিশু এবং ৭৭ জন পুরুষ। তাদের মধ্যে ১৩৪ জনই প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সেনা ও পুলিশের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছেন। চোখের সামনে পরিবারের সদস্যদের খুন হতে দেখার বিবরণ দিয়েছেন ৯৬ জন। ১১৫ জন বর্ণনা দিয়েছেন অপহরণ ও গুমের এবং ১৩১ জন বলেছেন তারা মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৯১ জন জানিয়েছেন, পরিবারের একাধিক সদস্য সেনাবাহিনীর হাতে অপহৃত হওয়ার পর এখনও ফিরে আসেনি। ৮৮ জন নারী যৌন নির্যাতনের বিবরণ দিয়েছেন, যাদের মধ্যে ২৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এই নারীদের অনেকেই তাদের প্রতিবেশী ও পরিচিত নারীদের গণধর্ষণের শিকার হতে দেখেছেন। ১৩২ জন তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার এবং ৮১ জন তাদের বাড়িতে ব্যাপক লুটের বিবরণ দিয়েছেন। একজন বলেছেন, সেনা ও পুলিশের সঙ্গে বৌদ্ধ যুবকরাও হামলা-লুটপাটে অংশ নেয়। ছোট গজিরবিল থেকে আসা এক যুবক জানান, দুটি হেলিকপ্টার তাদের গ্রামের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এভাবে তিন দফায় চলে গুলিবর্ষণ। এতে তার পরিবারের সাত সদস্য নিহত হয়েছেন।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, মংডুর বড় গজিরবিল, ছোট গজিরবিল, কেয়ারিপাড়া, জামবুনিয়া, নাইচ্যাপ্রু, চালিপাড়া, রাবিলা, ওয়াবেগসহ বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাসদস্যরা। সেখানে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন অনেক রোহিঙ্গা।

গণধর্ষণের বর্ণনা :রাখাইন রাজ্যের মংডুর বড় গজিরবিল থেকে আসা ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী কমিশনের কাছে বলেছেন, সেনাসদস্যরা বাড়িতে ঢুকে তার স্বামীকে গলা কেটে হত্যা করে। পরে স্বামীর মরদেহের সামনেই পাঁচ সেনা পালাক্রমে তাকে ধর্ষণ করে। এ সময় তার আট মাস বয়সী শিশুটি কান্নাকাটি করলে সেনারা তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। ছোট গজিরবিল এলাকা থেকে টেকনাফে পালিয়ে আসা ২২ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা তরুণী জানিয়েছেন, সেনারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করে। তিনি জানি না বলতেই তাকে প্রহার শুরু করে। পরে চার-পাঁচ সেনা তাকে ধর্ষণ করে। ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী কমপক্ষে পাঁচ সেনাসদস্যের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ১৪ বছরের এক কিশোরী জানায়, তার ৮ ও ১০ বছর বয়সী দুই বোনকে সেনারা ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। ১৮ বছরের এক তরুণী বলেছেন, তার ৬০ বছর বয়সী মাকে গলা কেটে হত্যা করেছে সেনারা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ নারী তাদের বাড়িতে ধর্ষিত হয়েছে। কাউকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। কাউকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেওয়ার কথা বলে গণধর্ষণ করা হয়েছে।

সেনাসদস্যরা গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। রোহিঙ্গাদের মজুদ খাদ্যশস্য, ক্ষেতের ফসলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু বাড়িঘর হারিয়ে নয়, খাদ্যের অভাবেও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে।

কমিশনের মূল্যায়ন :প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, ৯ অক্টোবরের পর সেনা অভিযানের নামে রোহিঙ্গাদের ওপর যে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে তাকে কোনো অবস্থাতেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যাবে না। দীর্ঘদিন থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর বৈষম্যমূলক আচরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে আসছে। রোহিঙ্গারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে যত সহজে আসতে পারে তত সহজে তাদের দেশে অন্য একটি গ্রামে যেতে পারে না। তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা জাতিগত ও ধর্মীয়ভাবে প্রতিহিংসা-বিদ্বেষে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনকে মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধ বলে মনে করছে কমিশন।
সুত্র: সমকাল

পাঠকের মতামত

‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার রাজি থাকা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ার কারণ খুঁজতে হবে’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ...